Total Pageviews

Feedjit Live

Tuesday, June 14, 2011

সক্রেটিস: জীবন ও দর্শন নিয়ে কিছু কথা


সক্রেটিস: জীবন ও দর্শন নিয়ে কিছু কথা


পাশ্চাত্য সভ্যতার ইতিহাসে মহান দার্শনিক সক্রেটিস (খ্রি. পূ. জন্ম: ৪৬৯-মৃত্যু: ৩৯৯, জন্মস্থান:এথেন্স, গ্রীস) এর নাম উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়ে আছে। তিনি এমন এক দার্শনিক আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রবর্তক যা-কিনা পাশ্চাত্য সভ্যতা, সংস্কৃতি ও দর্শনকে দুই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু লক্ষণীয় যে, মহাজ্ঞানী দার্শনিক হিসেবে বিশ্বব্যাপী যার এত সুখ্যাতি সেই সক্রেটিসের জীবন ও দর্শন সম্পর্কে বেশী কিছু জানা যায় না। তবে বর্তমানকালে তার জীবন ও দর্শনের তিনটি উৎসের উল্লেখ করা যেতে পারে, যথা- প্লেটোর ডায়ালগগুলো, এরিস্টোফেনিসের নাটকগুলো এবং জেনোফেনোর ডায়ালগগুলো। সক্রেটিস নিজে কিছু লিখেছেন বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

প্লেটোর বর্ণনামতে সক্রেটিসের বাবার নাম সফ্রোনিস্কাস, যিনি পেষায় একজন স্থপতি (অন্যমতে: ভাস্কর) এবং মায়ের নাম ফিনারিটি, যিনি একজন ধাত্রী ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম জ্যানথিপ। সংসার জীবনে তাদের তিন ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। অভাবের সংসার বলে সংসার জীবনে খুব একটা সুখী ছিলেন না। সংসারের জ্বাল-যন্ত্রণা ভুলতে তিনি বেশীরভাগ সময় দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন। সত্য ও জ্ঞানের প্রতি অবিচল সক্রেটিসকে তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী তথাকথিত অভিযোগে তাকে হেমলক বিষ পানে মৃত্যুদন্ড- দেয় এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সক্রেটিস নিজ হাতে বিষাক্ত হেমলকের রস পান করে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়েন। তার নশ্বর দেহটা এথেন্সে মাটিতে মিশে গেলেও তার আদর্শ ও চিন্তা যুগ যুগ মানুষকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার প্রেরণা যুগিয়েছে।সক্রেটিস তার নিজ দর্শন প্রচারের জন্য নির্দিষ্ট কোন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার প্রভৃতি যখন যেখানে সুবিধা সেখানেই আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার সাথে বিনামূল্যে তিনি দর্শন আলোচনায় প্রবৃত্ত হতেন। সোফিস্টদের মতো তিনি শিক্ষাদানের বিনিময়ে অর্থ গ্রহণকে ঘৃণা করতেন। দার্শনিক আলোচনার প্রতি তার এত বেশি ঝোঁক ছিল যে, তিনি প্রায়শই বলতেন: "নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়াই আমার অভ্যাস, আর এজন্যই এমনিতে না পেলে পয়সা-কড়ি দিয়ে হলেও আমি দার্শনিক আলোচনার সাথী সংগ্রহ করতাম।"তিনি নিজেকে কখনও সোফিস্টদের মত জ্ঞানী ভাবতেন না বরং তিনি বরং বলতেনঃ "আমি জ্ঞানী নই, জ্ঞানানুরাগী মাত্র। একটি জিনিসই আমি জানি; আর সেটি হলো এই যে, আমি কিছুই জানি না।"সক্রেটিসের শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিল বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির (dialecfical method) মাধ্যমে প্রথমে প্রতিপক্ষের মত স্বীকার করে পরে যৌক্তিক উপায়ে তা খন্ডন করতেন। বিরুদ্ধ পক্ষের জন্য তিনি তর্কের ফাঁদ পাততেন এবং পরাজিত হয়ে যতক্ষণ না প্রতিদ্বন্দ্বী নিজের ভুল স্বীকার করে, ততক্ষণ তাকে প্রশ্ন করতেন। অনবরত প্রশ্ন করে উপকথকের মন থেকে ভুল ধারণা দূর করে তার মুখ থেকেই তিনি সত্য বের করতেন।সক্রেটিস এই বিশ্বজগতের নিগূঢ় রহস্য নিয়ে আলোচনার চেয়ে জীবন ও সমাজের বাস্তব বিষয়াদি নিয়ে আলোচনায়ই তিনি ছিলেন বেশি আগ্রহী। যেমন, সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে মানুষের আচরণ কেমন হওয়া উচিত? মানুষের মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব কিসে নিহিত? - এ জাতীয় জীবনধর্মী প্রশ্নের উত্তরানুসন্ধানই ছিল তার চিন্তার অগ্রাধিকার। ন্যায় (justice) ও শুভ (goodness) কী, তা জানতে তিনি আগ্রহী ছিলেন ন্যায়নিষ্ঠ ও শুভজীবন-যাপনের জন্য। তার দৃঢ় বিশ্বাস ন্যায় ও শুভ কী, তা না জেনে কেউ ন্যায়বান ও কল্যাণনিষ্ঠ হতে পারে না। তার মানে, জ্ঞান ও প্রজ্ঞাই মানুষের সদাচরণ ভিত্তি। আরো এক ধাপ এগিয়ে সক্রেটিস বলেন, আচরণের জন্য জ্ঞানবুদ্ধি যে শুধু অপরিহার্য তাই নয়, সত্যিকারের জ্ঞানী ব্যক্তি কখনো অন্যায় করতেই পারেন না। আবেগ-উচ্ছ্বাস নয়, প্রজ্ঞাই (reason) ছিল তার চিন্তা ও কর্মের চালিকাশক্তি। প্রজ্ঞার আলোকে তিনি যে মূল্যবোধ দর্শন করেছেন, তাকেই তিনি নিষ্ঠার সাথে অনুশীলন করেছেন। ন্যায় ও কল্যাণের ধারণা থাকা সত্ত্বেও মানুষ কী করে অন্যায়-অকল্যাণে প্রবৃত্ত হতে পারে, এ ছিল তার চিন্তার বাইরে।সক্রেটিস মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, নিজ আত্মার যত্ন নেয়া, আত্মাকে সৎ ও শুভ লক্ষ্যে পরিচালিত করা মানুষের অভিষ্ট। আত্মা বলতে আমরা যা বুঝি, ইউরোপে সর্বপ্রথম এ ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন সক্রেটিস। তিনিই সর্বপ্রথম আত্মাকে কল্পনা করেছিলেন একটি বুদ্ধিসঞ্জাত নৈতিক শক্তি হিসাবে- এমন শক্তি যা ব্যক্তির ভালো বা মন্দ আচরণের জন্য দায়ী। আত্মার অমরত্ব প্রসঙ্গে সক্রেটিসের মত সম্বন্ধে বিস্তারিত কিছু জানা না গেলেও তিনি যে আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসী ছিলেন, তা তার একটি প্রসিদ্ধ উক্তি থেকে অনুমান করা যায়। অন্যায় অপবাদে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সক্রেটিস হেমলক লতার বিষপানের পর মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে শোকাভিভূত আত্মীয়-পরিজনদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, "তোমরা দুঃখ করো না। কারণ, এই মৃত্যু কেবল আমার দেহটাকেই বিনাশ করবে, আত্মাকে নয়।"সক্রেটিস গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন শিক্ষাই মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, শিক্ষার মধ্যেই মানুষের অন্তরে জ্ঞানের পূর্ণ জ্যোতি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। জ্ঞানের মধ্যদিয়েই মানুষ একমাত্র সত্যকে চিনতে পারে। যখন তার কাছে সত্যের স্বরূপ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সে আর কোনো পাপ করে না। অজ্ঞানতা থেকেই সব পাপের জন্ম। তিনি চাইতেন মানুষের মনের অজ্ঞানতাকে দূর করে তার মধ্যে বিচার-বুদ্ধিবোধকে জাগ্রত করতে। তিনি যুবকদের সুপথে পরিচালিত হওয়ার শিক্ষা দিতেন। সক্রেটিস তীব্রভাবে বিশ্বাস করতেন যে দুনিয়া সম্পর্কে জানার আগে মানুষকে নিজেকে জানতে হবে; এর একমাত্র মাধ্যম হলো যৌক্তিক চিন্তাভাবনা। তাই তিনি জোরের সাথে বলেছেন জগতকে জানতে হলে আগে নিজেকে জানতে হবে, এই প্রেক্ষাপটেই সক্রেটিস বলেছিলেন (know thyself)।সক্রেটিসকে যদি হেমলক পানে মারা না হত তাহলে জগৎ হয়তো আরো অনেক মহৎ জ্ঞান পেতে পারত। কিন্তু তার মৃত্যুর মধ্যদিয়ে তার নশ্বর দেহের শেষ হলেও চিন্তার শেষ আজও হয়নি। তার প্রিয় শিষ্য প্লেটো এবং প্লোটোর শিষ্য অ্যারিস্টটলের মধ্যদিয়ে সেই চিন্তার এক নতুন জগৎ সৃষ্টি হলো, যা মানুষকে উত্তেজিত করছে আজকের পৃথিবীতে।(ছবি ও তথ্য সংগ্রহ: ইন্টারনেট)


    0 comments:

    Post a Comment

    Twitter Delicious Facebook Digg Stumbleupon Favorites More